삼일절 ১ মার্চ কোরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দিবস

Spread the love

কোরিয়ার পাঁচটি জাতীয় দিবসের মধ্যে এটি অন্যতম। দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ ভালোবাসা এবং সম্মানের সঙ্গে দিনটি স্মরণ করে। এ দিনটি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানা প্রয়োজন।

জাপানিজদের শাসন থেকে মুক্তির জন্য কোরিয়ানদের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় ১৯১৯সালের এই দিনে। কোরিয়ান ভাষায় ‘সাম’ মানে তিন আর ‘ইল’ মানে এক। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসের এক তারিখ থেকে জাপানিজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয় বলে এই আন্দোলন ‘সামিল’ (সাম+ইল)নামে পরিচিত। ইংরেজিতে এই আন্দোলন Samil Independence Movement এবং March First Movement নামে পরিচিত। এই আন্দোলন নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফের বিশেষ প্রতিবেদন।

ইতিহাস

দক্ষিণ কোরিয়ার জোসন রাজপরিবারের ৫০০ বছরের শাসন শেষ হয় ১৯১০ সালে জাপান কোরিও উপনিবেশ শাসন চালুর মাধ্যমে। ১৯১০ সালের অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ জাপান শাসন ব্যবস্থা চালু করে। প্রথম দিক থেকে জাপান মিলিটারিরা কোরিয়ানদের উপর লুটপাট খুন-ধর্ষণ অত্যাচার নিপীড়ন নির্যাতন ব্যাপকহারে চালাতে থাকে। প্রথম ৯ বছরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় কোরিয়া নাগরিকদের। এরমধ্যে জাপানিজরা তাদের সংস্কৃতি ভাষা এবং শাসনব্যবস্থা কোরিয়ান দের উপর চাপানোর চেষ্টা করে। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখ জোসন রাজপরিবারের শেষ রাজা খোজং(고종 황제) মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু সকলে জানতে পারে তাকে বিষাক্ত চা (독살설)পানের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনটা জোরদার হতে থাকে।

 

জাপানি উপনিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সে সময়ের প্রধান তিনটি ধর্মের যাজকেরা মোট ৩৩ জন সদস্য মিলে একটি সভার আয়োজন করে। প্রথমে দিনটি ১৯১৯সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখ রাজার সমাধির তারিখের সঙ্গে মিল রেখে করার কথা থাকলেও অধিকাংশের ভোটে ১ তারিখে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল বর্তমান কোরিয়ার রাজধানী সিউলের থাপকোল পার্ক (탑골공원)। মার্চ মাসের ১তারিখ সকাল থেকে মেঘের মতো মানুষেরা এইখানে আসতে শুরু করে। কিন্তু ধর্মযাজক নেতারা এখানে হত্যাকাণ্ড পূর্বাভাস পেয়ে এইখানে উপস্থিত হয় না। কিন্তু তারা তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছাত্রদের ইতিমধ্যে বিতরণ করে ফেলে। ধর্মযাজক এরা তাদের সবার স্থান পরিবর্তন করে দ্যৈওয়াখোয়ান(태화관) নামক স্থানে। কিন্তু আন্দোলনটা জোরদার হয় পার্ক থেকে। ধর্মীয় নেতাদের আশা না দেখে ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে একজন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মানুষের মুখে মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়গাণ মুখরিত হতে থাকে(대한독립만세). জাপানি সৈনিকরা এখানে গুলি চালায়। ছাত্র শিশুশ্রমিক সাধারন জনগন অনেকেই এখানে শহীদ হয়। মানুষেরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কিন্তু তাদের হাতের পতাকাকে উজ্জীবিত করে মুখে মুখে মুখরিত হতে থাকে কোরিয়ার জয়গান 대한 독립 만세.

মুহুর্তের মধ্যে এই আন্দোলনে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। জাপানি মিলিটারিদের গুলি লাঠিচার্জে মৃত্যুবরণ করে ৭৫০৯ জন আহত হয় ১৫৮৪৯ জন এবং প্রায় ৪৬৩০৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই আন্দোলনের কারণে দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীনতার আন্দোলনের কথা বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়। বিভিন্ন দেশ দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করতে থাকে। ১৯১৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে প্যারিস কনফারেন্সে জাপানের কঠিন সমালোচনা করা হয়। একই বছর এপ্রিলে আমেরিকা সহ জাপানের নেক্কারজনক কাজের নিন্দা জানান। এপ্রিল মাসে চীনে অস্থায়ী সরকার গঠন করে কোরিয়া এবং এই দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

১৯১০ সালে জাপান কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত কোরিয়ানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জাপান এবং আমেরিকায় কোরিয়ানরা ছোট পরিসরে এর প্রতিবাদ শুরু করে। মূল প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ১৯১৯ সালে ৮ জানুয়ারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলসনের প্যারিস শান্তি সম্মেলনে “Fourteen Points” ভাষণের পর। এই সময় কোরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট রি সোং মান এর নেতৃত্বে আমেরিকার হাওয়াই এ গঠিত হয় কোরিয়া ন্যাশনালিস্ট এসোসিয়েশন। সংগঠনটি প্যারিস সম্মেলনে কোরিয়ার স্বাধীনতা বিষয়টি নজরে আনার চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টা করার পরও বিভিন্ন কারণে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।

সামিল আন্দোলনের সময় রাস্তায় হাজার হাজার কোরিয়ান জনতা

সামিল আন্দোলন শুরু যেভাবে

জাপানে অধ্যয়রত কোরিয়ান ছাত্রছাত্রীরা ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে গোপনভাবে কোরিয়াকে স্বাধীন করার জন্য  Korean Youth Independence Corps নামে একটি সংগঠন তৈরী করে। সংগঠনটি কোরিয়ান, জাপানিজ এবং ইংরেজি তিন ভাষায় “Declaration of Independence”  এর ড্রাফট তৈরী করে। ড্রাফটি কোরিয়াতে পাঠানো হয় এবং জানানো হয় ৮ ফেব্রুয়ারী জাপানের কোরিয়ান ছাত্রছাত্রীরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিবে।

ঘোষণা অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারী সকল সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার একটি পত্র পাঠানো হয়। জাপানের মন্ত্রী পরিষদ, কোরিয়ায় নিযুক্ত গভর্ণরসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে এর কপি পাঠানো হয়। সেইদিন বিকেলে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনের উদ্দ্যেশ্যে জড়ো হতে থাকে। কিন্তু পুলিশ তাদের শেষ পর্যন্ত তাদেরকে এক হতে দেয়নি। ঘটনাস্থল থেকে ২৭জনকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিকভাবে আন্দোলন থেমে যেতে বাধ্য হয়।

আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করছে মিলিটারী পুলিশ

সামিল আন্দোলন এবং এর ফলাফল

১ মার্চে কোরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেন ৩৩জন কোরিয়ান জাতীয়তাবাদী। সিউলের জোংনো’র একটি রেস্টুরেন্টে এই ৩৩জন একটি বৈঠকে মিলিত হন। প্রথমদিকে তারা সংঘর্ষ এবং প্রাণহানি এড়াতে শান্তিপুর্ণ আন্দোলনের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারী কোরিয়ান ভাষা এবং জাপানিজ ভাষায় The Independence News নামে একটি স্বাধীনতা পত্র তৈরী করে ২১ হাজার কপি প্রিন্ট করা হয়।

পত্রটি ১ মার্চ কোরিয়ার সিউল, পিয়ংইয়ংসহ বিভিন্ন জনবহুল এলাকাগুলোতে (বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া) প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। সকালে লিফলেট বিলি হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। দুপুর গড়ানোর আগেই বিভিন্ন স্থানে মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। ২টার দিকে জনতা কোরিয়ার পতাকা উত্তোলন করে। একজন ছাত্র ছোং জে ইয়ং স্বাধীনতা পত্রটি উপস্থিত জনতাকে পড়ে শোনান। সিউল প্রকম্পিত হয় ‘মানসে (만세-Long live Korea)’ শ্লোগানে। উপস্থিত জনতা সিউলের দকসোগুং প্যালেস, জোংনো, আমেরিকান দূতাবাস, ফ্রান্স দূতাবাসসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল শুরু করে। পথে পথে পুলিশ বাধা দেওয়া শুরু করে। এর মধ্যেই আন্দোলনের ডাক দেওয়া নেতাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

নেতাদের  গ্রেফতারের পর আন্দোলনের গতি বেড়ে ক্রমেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকলে জাপানিজ কলোনিয়াল সরকার মিলিটারী পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমন করতে থাকে। প্রায় একবছর এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল। চুড়ান্ত সাফল্য না দেখলেও এই আন্দোলনকেই কোরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ মনে করা হয়।

বছরব্যাপী এই আন্দোলনে অংশ নেয় প্রায় ২০লাখ কোরিয়ান। কোরিয়ান সরকারের বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী আন্দোলনে প্রাণ হারায় ৭৫০০ এবং আহত হয় ১৬ হাজার জন কোরিয়ান। ৪৭ হাজার কোরিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য স্থাপনা।

গুরুত্ব:

এই স্বাধীনতার ঘোষণা আন্দোলনটি প্রথমে ব্যর্থ হলেও মূলত এটি কোন ব্যর্থ আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা স্বাধীনতা আন্দোলন করার সাহস পেয়েছিল। আমরা যদি সহজ কথায় বলতে চাই তাহলে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যেমন প্রথম জয় পেয়েছিলাম, এই আন্দোলন স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছিল। ৩৫ বছরের উপনিবেশ শাসনের পরে ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পতাকা উত্তোলন: যেহেতু এটি দক্ষিণ কোরিয়া স্মৃতি বেদনা দিবস সেহেতু পতাকাকে অর্ধনির্মিত অবস্থায় উত্তোলন করতে হয়। প্রথমে পতাকাটি সম্পূর্ণ উত্তোলন করে তারপরে এক পতাকার দৈর্ঘ্য নিচে পতাকাটি টাঙ্গানো হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রত্যেকটি ভাষা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তায় রাস্তায় এদিন অর্ধনিমিত পতাকার সমারোহ দেখা যায়। পতাকার অর্ধনির্মিত রূপকে কোরিয়ান ভাষায় বলা হয় জোগী(조기)।

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *